রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত ৬, আহত ১২ - কক্সবাজার কন্ঠ

বৃহস্পতিবার, ২ মে ২০২৪ ১৯শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বৃহস্পতিবার

প্রকাশ :  ২০২১-১০-২২ ১২:৪১:০৪

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত ৬, আহত ১২

নিজস্ব প্রতিবেদক : কক্সবাজারের উখিয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সন্ত্রাসীদের এলোপাতাড়ি গুলি ও ধারালো অস্ত্রের আঘাতে ৬ জন নিহত হয়েছে। এ ঘটনায় আরও ১২ জন গুরুতর আহত হয়েছে। আর সংগঠিত ঘটনাটি সংঘর্ষ নয় একটি মাদ্রাসায় পরিকল্পিত হামলা। পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। ক্যাম্পে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।

রোহিঙ্গা শিবিরের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ৮ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন এই হামলায় ৭ জন নিহত হওয়ার কথা বলেছিল। কিন্তু পরে তারা জানিয়েছে ওই হামলায় ৬ জন নিহত হয়েছে। ওই হামলায় আহত মাদ্রাসা ছাত্র ও ১৮ নম্বর শিবিরের বøক এইচ-৫২ এর বাসিন্দা নুর কায়সারকে (১৫) আশঙ্কাজনক অবস্থায় কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

নিহতরা হলেন ওই মাদ্রাসার শিক্ষক ১২ নম্বর ক্যাম্পের বাসিন্দা মো. ইদ্রীস (৩২), ৯ নম্বর ক্যাম্পের বাসিন্দা ইব্রাহীম হোসেন (২৪), মাদ্রাসার ছাত্র ও ১৮ নম্বর ক্যাম্পের আজিজুল হক (২২), একই ক্যাম্পের ভলান্টিয়ার মো. আমীন (৩২), মাদ্রাসার শিক্ষক ও ১৮ নম্বর ক্যাম্পের বাসিন্দা নুর আলম ওরফে হালিম (৪৫), মাদ্রাসার শিক্ষক ও ২৪ নম্বর ক্যাম্পের হামিদুল্লাহ (৫৫)। এ ঘটনায় আরও ১২ জন গুরুতর আহত হয়েছে। তাদের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।

৮ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ানের (এপিবিএন) অধিনায়ক পুলিশ সুপার মো. শিহাব কায়সার খান বলছেন, শুক্রবার (২২ অক্টোবর) ভোর সাড়ে ৪টার দিকে উখিয়া উপজেলার পালংখালী ইউনিয়নের ১৮ নম্বর ময়নারঘোনা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এই হামলা হয়। নিহতরা সবাই ওই ক্যাম্পের এইচ-৫২ বøকের দারুল উলুম নাদওয়াতুল ওলামা আল-ইসলামিয়াহ মাদ্রাসার শিক্ষক, ছাত্র ও ভলান্টিয়ার। শিহাব কায়সার বলেন, পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। ক্যাম্পে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। অস্ত্রসহ একজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তার নাম মুজিবুর রহমান। তার কাছ থেকে একটি ওয়ান শুটারগান, ৬ রাউন্ড গুলি ও একটি ছুরি উদ্ধার করা হয়েছে।

ঘটনার সংবাদ পেয়ে শুক্রবার দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মামুনুর রশীদ, শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) শাহ নেওয়াজ হায়াত। তবে তাঁরা এ হত্যাকাÐের বিষয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি।

সূত্র জানিয়েছে, কক্সবাজার শহর থেকে ৮০ কিলোমিটার দূরে উখিয়ার থাইনখালী (ক্যাম্প-১৮) রোহিঙ্গা ক্যাম্প। ক্যাম্পের মাঝামাঝি একটি সড়কের পাশে টিনের ছাউনি দেয়া একটি মাদ্রাসা। মাদ্রাসার পাশে একটি মসজিদ। মাদ্রাসা ও মসজিদটি পরিচালনা করে ইসলামী মাহাস নামের একটি রোহিঙ্গাদের সংগঠন। শুক্রবার দিবাগত রাত সাড়ে তিনটার দিকে ওই মাদ্রাসায় হামলা চালায় ৪০ থেকে ৫০ জন সশস্ত্র সন্ত্রাসী। সন্ত্রাসীদের এলোপাতাড়ি গুলি ও ধারালো অস্ত্রের আঘাতে ৬ জন নিহত ও ১২ জন গুরুতর আহত হয়েছে।

হামলার ঘটনায় মিয়ানমারের সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আরাকান স্যালভেশন আর্মি আরসাকে (আল ইয়াকিন নামে পরিচিত) দায়ী করছেন রোহিঙ্গা নেতারা। কারণ, বাংলাদেশে অবস্থানকারী রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরে যাওয়া নিয়ে ইসলামী মাহাস নেতাদের সঙ্গে আরসার বিরোধ চলে আসছিল। তবে পুলিশ বলছে, বাংলাদেশে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে আরসা বা আল ইয়াকিনের কোনো অস্তিত্ব নেই।

দারুল উলুম নাদওয়াতুল ওলামা আল-ইসলামিয়া নামের ওই মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক মৌলভী দিন মোহাম্মদ বলেন, দিবাগত রাত সাড়ে তিনটায় মাদ্রাসার শিক্ষক-ছাত্র মিলে অন্তত ২৫ জন মসজিদে তাহাজ্জুতের নামাজ পড়তে যান। এ সময় অস্ত্রধারীরা মসজিদে ঢুকে এলোপাতাড়ি গুলি করতে থাকে। মসজিদের বাইরে পাহারায় ছিল আরও ৪০ জনের বেশি মুখোশধারী সন্ত্রাসী। গুলির আওয়াজ শুনে সাধারণ রোহিঙ্গা ও ক্যাম্পের রোহিঙ্গা নেতারা এগিয়ে এলে তাঁদের লক্ষ্য করেও গুলি চালানো হয়। তিনি আরও জানান, এর মধ্যে প্রথম ৪ জন ঘটনাস্থলে এবং অপর ২ জনকে উখিয়াস্থ এমএসএফ হাসপাতালে নেয়ার পর মৃত ঘোষণা করা হয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে মাদ্রাসার আশপাশে থাকা কয়েকজন রোহিঙ্গা জানান, গত ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে উখিয়ার লাম্বাশিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ডি বøকে আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের কার্যালয়ে ওই সংগঠনের চেয়ারম্যান মুহিবুল্লাহ বন্দুকধারীদের গুলিতে নিহত হন। আরসা নেতা আবদুর রহিমের নেতৃত্ব ২০ থেকে ২৫ জন রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী ওই হামলা চালিয়েছিল।

এ পর্যন্ত মুহিবুল্লাহ হত্যার সঙ্গে জড়িত আরসার ৫ জন সদস্য ও ৪০ জনের বেশি রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গ্রেপ্তার হয়েছে। আরসা সদস্যদের আটকের বিষয়ে পুলিশকে তথ্য দিয়ে ইসলামী মাহাসের সদস্যরা সহযোগিতা করেছেন। তারই সূত্র ধরে ওই মাদ্রাসা-মসজিদে হামলা চালানো হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

রোহিঙ্গাদের ভাষ্য, মসজিদ-মাদ্রাসায় হামলার ঘটনায় ৬ রোহিঙ্গা খুনে আরসা জড়িত। মসজিদ-মাদ্রাসাটি দখলের জন্য এর আগেও কয়েকবার হামলা চালিয়েছিলেন আরসা।

৮ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) অধিনায়ক এসপি শিহাব কায়সার খান আরও জানান, সন্ত্রাসীদের গুলিতে ৬ রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়েছে। ময়না তদন্তের জন্য লাশগুলো কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়েছে। হামলার কারণ, কারা হামলা করেছে সেসব ব্যাপারে কিছুই জানা যায়নি। এ ঘটনায় মুজিবুর রহমান নামের একজন রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীকে অস্ত্রসহ আটক করা হয়েছে।

পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, রোহিঙ্গা শিবিরে মিয়ানমারের সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আরসা অথবা আল ইয়াকিন নামের কোনো সংগঠনের তৎপরতা নেই। তবে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা আরসা এবং আল ইয়াকিনের নাম ব্যবহার করে অপতৎরতা চালাচ্ছে। ইতিমধ্যে তাদের বেশ কয়েকজনকে আগ্নেয়াস্ত্রসহ আটক করা হয়েছে। অন্যদের ধরতে ক্যাম্পে সাঁড়াশি অভিযান চালানো হচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ময়নারঘোনা পুলিশ ক্যাম্পের সদস্যরা শুক্রবার দিবাগত রাতে স্থানীয় মদুতুল উম্মা মাদ্রাসা ও আশপাশের এলাকায় প্রায় আড়াই ঘণ্টা ধরে ঘেরাও করে তল্লাশি চালিয়েছিলেন। অন্যান্য ক্যাম্প এলাকাতেও একই সাথে অভিযান চালানো হয়েছে। এর ঘণ্টা দেড়েক পর দারুল উলুম নাদওয়াতুল ওলামা আল-ইসলামিয়াহ মাদ্রাসায় এ হামলা হয়।
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবিরে পরিণত হওয়া কক্সবাজারের এই ক্যাম্পগুলোতে এর আগেও বিভিন্ন সময়ে গোলাগুলি ও সংঘর্ষ হয়েছে। পুলিশের পক্ষ থেকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেগুলোকে রোহিঙ্গা ডাকাত বা চোরাকারবারিদের কাজ বলা হয়েছে। তবে রোহিঙ্গা নেতা মাস্টার মুহিবুল্লাহ খুন হওয়ার পর ক্যাম্পে সক্রিয় বিভিন্ন পক্ষের অনেক বিষয় এখন আন্তর্জাতিক পর্যায়েও আলোচনায় আসছে।

গত ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে কুতুপালং-১ (ইস্ট) লম্বাশিয়া ক্যাম্পের ডি-৮ বøকে গুলি করে হত্যা করা মুহিবুল্লাহকে, যিনি আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস নামের একটি সংগঠনের চেয়ারম্যান ছিলেন।

পরিবারের অভিযোগ, প্রত্যাবাসনের পক্ষে জনমত গঠনে কাজ করা মুহিবুল্লাহকে রোহিঙ্গাদের আরেকটি সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) হত্যা করেছে।

উল্লেখ্য যে, কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে অস্থিরতা তৈরির চেষ্টায় মিয়ানমার থেকে বিভিন্নভাবে অস্ত্র আসছে বলেও মন্তব্য করেছেন খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল।

আরো সংবাদ